১/ লক্ষ্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা
– নিজেকে প্রশ্ন করুন, পড়ার ক্ষেত্রে আপনার লক্ষ্য কী? কেন পড়ছেন বা পড়বেন? সেই লক্ষ্যটা স্মরণ রাখা। উদাহরণস্বরূপ আমি পড়ব- কারণ আল্লাহ তাআলা আমাকে পড়ার আদেশ দিয়েছেন। তিনি আমাকে এবং সকল মুসলিমকে স্পষ্ট আদেশের সুরে বলেছেন, اقرأ-পড়ো। আমি পড়ব- কারণ আমি দুনিয়া ও আখিরাতে উপকৃত হতে চাই। আমি পড়ব- কারণ আমি আমার চারপাশের মানুষকে উপকৃত করতে চাই। দ্বীন ইসলামের খেদমত করতে চাই…
২/ পড়ার পরিমাণ নির্ধারণ করা
– লক্ষ্য যখন নির্ধারিত হবে, তখন এলোমেলোভাবে পড়ার কোনো সুযোগ থাকে না। তবে গোছালোভাবে পড়তে চাইলে পড়ার জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে নেয়া অতীব জরুরী। সর্বপ্রথম আপনি আপনার সময় এবং সক্ষমতা বুঝুন। এবং গভীর চিন্তা ভাবনার সাথে সে পরিমাণ অনুযায়ী বই নির্ধারণ করুন। এমন কোনো সিরিজ নির্বাচন করবেন না, যা পড়ার সময় বা সক্ষমতা আপনার নেই। এই এক সপ্তাহে কোন বই শেষ করতে চান? আগামী এক মাসে কী কী বই শেষ করতে চান? এভাবে ১ বছর থেকে শুরু করে নির্ধারণ করুন, ৫ বছর পর আপনি কোন কোন বিষয়ে ইলম অর্জন করতে চান।
৩/ পড়ার সময় নির্ধারণ করা
– পড়ার জন্য নির্ধারিত সময় বের করে নিতে হবে। এটাও খুব জরুরী। নয়ত সময়ের ভুল ব্যবহার পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে। আর তাই এই নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। পড়ার জন্য এমন সময় নির্ধারণ করবেন- যখন আপনার মস্তিষ্ক থাকে সতেজ সজীব এবং আপনিও থাকেন নির্ভার সুস্থির। কারণ জীবনে সুন্দর কিছু অর্জন করতে হলে আপনার সকল মনোযোগ পড়ার সময় কেন্দ্রীভূত রাখতে হবে। ফজরের পর, আসরের পর- এই সময়ে মস্তিষ্ক খুব সচল থাকে। কর্মজীবী ব্যস্ত মানুষদের ক্ষেত্রে কাজের ফাঁকের সময়গুলো থেকে সুবিধা অর্জন করতে হবে। দীর্ঘ জ্যামে বসে জানালার বাহিরে তাকিয়ে না থেকে স্মার্টফোনটি কাজে লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া হেড ফোনে হারাম গান না শুনে কোনো লেকচার সিরিজ শেষ করে ফেলতে পারেন অফিস যাতায়াতের পথেই।
৪/ পরিমিত ধীরতা
– ওপরের নিয়মগুলো পড়ে কেউ কেউ নিশ্চয় পড়ার প্রতি ভীষণভাবে উদ্দীপিত হবে। হয়ত অমিত আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বহু বই কিনে এনে গোগ্রাসে গিলতে থাকবেন। এমনও হতে পারে যে, তার এই বুভুক্ষ পাঠ জীবনের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় দখল করে নেবে। আমি বলি, বন্ধু একটু ধীরে…এ পথ বড় কঠিন ও অমসৃণ, এখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বিচক্ষণতার সাথে। বিশেষ করে আপনি যদি পড়ার ব্যাপারে আগে থেকে তেমন ‘অভ্যস্ত’ না হয়ে থাকেন; তবে এমনটি করবেন না। নতুবা খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। বরং আপনাকে হতে হবে অলিম্পিকের ‘ম্যারাথন’ দৌড়বিদদের মতো। বিশাল দীর্ঘপথ তারা দৌড়ায়। কিন্তু সূচনা হয় খুবই ধীর ও মন্থরতার সাথে। এরপর ক্রমান্বয়ে গতি বাড়াতে থাকে এবং অবশেষে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। পড়ার বিষয়টিও ঠিক এমন হতে হবে।
৫/ একাগ্রতা
– পড়া কোনো শখের বিষয় নয়। এটা অনেক কষ্ট ও পরিশ্রমের কাজ। মেধা, বুদ্ধি ও চিন্তা এবং সম্পদের পাশাপাশি প্রয়োজন ধৈর্য, আন্তরিকতার সাথে নিজেকে উৎসর্গ করা। প্রতিটি শব্দ-বাক্য পূর্ণ মনোযোগের সাথে বোঝা দরকার, যাতে এই পঠন দ্বারা অন্যদেরও উপকৃত করা যায়। পড়তে পড়তে এমন অনেক বিষয় আসবে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো নোট খাতায় তুলে রাখতে হবে। অথবা বইতেই নোট করে ফেলতে হবে। বইকে ঘরের শো পিস বানাবেন না। দাগান, লিখুন, কাটুন- এতে পঠিত বিষয় মস্তিষ্কে হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং পরবর্তীতে আপনার এই বই অন্য কাউকে দিলে, সেও আপনার নোট থেকে উপকৃত হতে পারবে। গল্পের বইয়ের মত শুয়ে বসে এক নাগাড়ে পড়ে যাওয়া- খুব প্রোডাক্টিভ কিছু বয়ে আনে না। তাই পড়ার সময়টায় সিরিয়াস হওয়া প্রয়োজন।
৬/ নিয়ম ও শৃঙ্খলা
– নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা অতি উচ্চমানের দুটো গুণ। ইলম অর্জনকারীর জন্য আবশ্যিক, তার জীবন হবে পরিপাটি এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সে হবে নিয়মানুবর্তী। আপনি আপনার লিখিত নোটটি দিয়েই শুরু করুন। প্রত্যহ পড়ার মাঝে যা লিখছেন, সেগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজান। এলোমেলো নোট দিন শেষে আপনার পড়াকে গুলিয়ে ফেলবে। এই জন্য প্রতিটি বিষয়ে আলাদা খাতা রাখা উত্তম। সীরাহ বিষয়ে আলাদা থাকে, কুরআন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নোট করার জন্য আলাদা খাতা, মনে রাখার মত হাদীসসমূহের জন্য আরেক খাতা..ইত্যাদি। এভাবে ইলমের প্রতিটি সেক্টরে, আপনার পড়া অনুযায়ী আলাদা খাতা বা অনলাইন নোট প্যাড খুলে রাখুন। এতে ভবিষ্যতে যে কোনো বিষয়ে কিছু প্রয়োজন হলে চট করে খুঁজে বের করতে পারবেন।
৭/ পারিবারিক লাইব্রেরি করা
– একটি শিক্ষিত জাতি গড়ার জন্য পারিবারিক লাইব্রেরির গুরত্ব অনেক। কারণ পরিবারই প্রত্যেক শিশুর প্রথম স্কুল। আপনি আপনার জীবনের বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে এটা গ্রহণ করুন। অতঃপর জীবনের লক্ষ্য অনুযায়ী লাইব্রেরিটি সাজান। এই ক্ষেত্রে ইলমী বইগুলো আপনার জন্য সাদাকায় জারিয়ে হিসেবে থেকে যাবে; আপনার লাইব্রেরি থেকে যত মানুষ উপকৃত হবে, তাদের প্রত্যেকের পড়ার বিনিময়ে আপনি সাওয়াব পেতে থাকবেন। ভেবে দেখেছেন কখনো, ৫০ টাকার একটা ছোট্ট বই আপনাকে মৃ্ত্যুর পরেও উপকৃত করতে থাকবে?! তবে হাঁ, লাইব্রেরি গড়তে গিয়ে যেন পড়া থেমে না যায়। আজকাল অনেকেই বইয়ের পর বই কিনে লাইব্রেরি বানায়, কিন্তু পড়ার সময় বের করে না। আপনার হাতের নাগালেই সব ছিল, কিন্তু সেগুলোর সঠিক ব্যবহার দ্বারা আপনার আখিরাতকে সুন্দর করতে পারলেন না- এর চেয়ে বড় দূর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? তাই বলছি- ১ ও ২নং পয়েন্টের দিকে মন দিন।
৮/ পঠিত বিষয় অন্যের কাছে উপস্থাপন করা
– এর ফলে অধিত জ্ঞান আরও ভালোভাবে মাথায় বসে যাবে; আপনার শিক্ষা দ্বারা অন্যরাও উপকৃত হবে; অতঃপর আপনার শেখানো বিষয় যত মানুষ ছড়িয়ে দেবে, এবং যাদের কাছে পৌঁছাবে, প্রত্যেকের শ্রবণ ও পঠনের বিনিময়ে আপনিও সাওয়াব পেতে থাকবেন। অর্থাৎ এটিও একটি সাদাকায়ে জারিয়ার মত। এ ক্ষেত্রে আপনার বন্ধু, সহপাঠী, বিবাহিত হলে স্ত্রী-সন্তান উপযুক্ত প্লাটফর্ম জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার। নির্দিষ্ট একটি সময়ে তাদের সাথে পঠিত বিষয়ে আলোচনা করুন।
৯/ পড়ার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা
– গ্রুপ স্ট্যাডি যাকে বলে। আমরা যারা কলেজ-ইউনিভার্সিটি ছাত্র, একটি সুন্দর গ্রুপ স্ট্যাডির উপকারিতা খুব ভাল করেই জানি। ইলম অর্জনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ গ্রুপ স্ট্যাডি করুন। আপনার তৈরিকৃত সিলেবাসের সাথে সামঞ্জ্য আছে এমন বন্ধুদের সাথে একটি গ্রুপ তৈরি করুন। এ গ্রুপ ফেসবুকেও হতে পারে। সপ্তাহে বা মাসে একদিন পঠিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। কে কী বুঝলেন সেটা তুলে ধরুন; এতে জানা বিষয়ে স্বচ্ছতা আসবে এবং অজানা বিষয়েও জ্ঞান লাভ হবে ইন শা আল্লাহ। মনে রাখবেন, একতাবদ্ধ জ্ঞানের দৃঢ়তা অনেক বেশি।
১০/ শিক্ষক-আলিমদের থেকে শেখা
– যে কোনো বিষয়ে, পড়ার জন্য একজন শিক্ষক থাকা চাই। অফলাইন হোক বা অনলাইন, একজন বিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়নে কল্যাণের দার উন্মোচন হয়।। আর দ্বীনী বিষয়ে আলিমদের স্মরণাপন্ন হওয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একজন আলিম ব্যতীত সেলফ-স্ট্যাডি অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিকদের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। কারণ চোরাবালিগুলো তাদের জানা থাকে না। ফলে জ্ঞানের অসীম মরুভূমিতে কখন যে বিপদের গর্তেত পরে যাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রতিনিয়ত একজন আলিমের সংস্পর্শে না থাকতে পারলেও মাসে অথবা বছরে একবার হলেও দিক নির্দেশনা নিয়ে সে অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে।
তথ্য সূত্র: পড়তে ভালোবাসি– ড. রাগিব সারজানি।
পড়ার আরো কলাকুশল জানতে পড়ুন-
>> কী পড়বেন কীভাবে পড়বেন। লেখক : মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
>> আমি যেভাবে পড়তাম। লেখক : ড. আইদ আল কারণী
>> পরীক্ষার্থীদের জন্য ২০ টিপস। লেখক : মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
>> পড়ালেখার কলাকৌশল। লেখক : মাওলানা কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
>> দরদী মালীর কথা শোনো (১ম খণ্ড) লেখক : মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
>> দরদী মালীর কথা শোনো (২য় খণ্ড)
ইলম অর্জন বিষয়ক কিছু অনলাইন আর্টিকেল:
How to seek knowledge– by Shaykh Salih al munajjid
ইলমে দ্বীন অর্জনের পথ ও পদ্ধতি (pdf)
Top 6 Tips to Strengthen your Memory
7 Practical Ways to Acquiring Knowledge about Islam
THE PROPER STEPS OF SEEKING KNOWLEDGE
Our Home: A Haven of Knowledge
পরিবারের সবার জন্য দ্বীনশিক্ষা : আসুন! দ্বীন শিখি দ্বীন শেখাই
ইলম অর্জনের গুরুত্ব নিয়ে অসাধারণ কিছু ভিডিও লেকচার:
Signs of beneficial knowledge – Ali Hammuda
“The Qur’an: A privilege that has rights” – Ali Hammuda
Education is for life, not for living – Mirza Yawar Baig
Adab is the Foundation of Knowledge by Mirza Yawar Baig